ইসলামের ইতিহাস বিভাগের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
রাজশাহীর নিসর্গভূমি হিসেবে ইতোমধ্যে পরিচিতি পেয়েছে ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ রাজশাহী কলেজ। অবিভক্ত বাংলার শিক্ষার গৌরবময় ইতিহাসের ধারক-বাহক এ কলেজের অন্যতম একটি বিভাগ হলো ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি। প্রতিষ্ঠার পর থেকে একাডেমিক ফলাফলসহ নানামূখি সৃজনশীল কর্মকা-ের মাধ্যমে রাজশাহী কলেজে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ইতিবাচক চর্চা অব্যাহত রেখেছে। ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ প্রতিষ্ঠার ইতিহাস বেশ দীর্ঘ। রাজশাহী কলেজে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ প্রতিষ্ঠার কথা আলোচনার পূর্বে ‘ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়’-এর সৃষ্টি সম্পর্কে কিছু বলার প্রয়োজন মনে করি। উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে যখন ইউরোপীয় উপনিবেশবাদ সমগ্র পৃথিবীব্যাপী একটি ঈর্ষণীয় সাফল্যের ধারাবাহিকতায় অবস্থান করছিল, বলা যায় তখনই ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের যাত্রা শুরু। মূলত: ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বা Islamic History & Culture নামটি আমাদের নিজস্ব ইতিহাসের আলোকে সৃষ্টি হয়নি। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে যখন ইউরোপীয় উপনিবেশবাদের চরম প্রতিযোগিতা চলছিল তখন মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলটি ইউরোপীয় উপনিবেশবাদের জন্য বিশেষ প্রয়োজন হয়ে পড়ে। মধ্যপ্রাচ্যের বিশাল ভূমি তখন তুরস্কের অটোমান সুলতানদের অধীনে এবং অটোমানরা নিজেদের সমগ্র মুসলিম জাহানের খলিফা বলে দাবি করে বিশে^ একটি প্যান-ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন লালন করতেন। তাঁদেরকে খুশী করে স্বীয় রাষ্ট্রীয় স্বার্থ উদ্ধারের জন্য ইউরোপীয় রাষ্ট্রবর্গ যত পলিসি গ্রহণ করেছে তারমধ্যে সুলতানদের পক্ষে ‘ইসলামবাদ’ অন্যতম একটি। ইসলামের নাম ব্যবহার করে, অটোমান সুলতানদের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে তুলে ধরে, তাদের শাসনকে গৌরবান্বিত করে এবং সহায়তা দিয়ে তাদেরকে স্বীয় অনুকুলে আনার একটি বিশেষ প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। এ প্রচেষ্টায় জার্মানরা ‘সিস্টেম অব এলায়েন্সের’ প্রেক্ষাপটে অটোমান সুলতানদের সাথে একটি বিশেষ মিত্রতা সৃষ্টি করার প্রয়াস পায়। ইংরেজ, ফরাসি, ওলন্দাজ ও স্পেনিশরা তাদের নৌ-পারদর্শিতার ফলে ভারতবর্ষ বা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আসার সুযোগ করে নিয়েছিলেন উত্তমাশা অন্তরীপ বা ম্যাজেলান প্রণালী হয়ে। কিন্তু জার্মানরা চেষ্টা করলেন বার্লিন-বাগদাদ রেলওয়ে প্রজেক্টের মাধ্যমে উপসাগর হয়ে অল্প সময়ে ভারত মহাসাগরে আগমনের। এতে জার্মান এবং অটোমানরা উভয়েই খুশি। এরই প্রেক্ষাপটে প্রখ্যাত জার্মান ঐতিহাসিক ইগনাস গোন্ডসিয়ের তাঁর গবেষণামূলক গ্রন্থ ‘ইসলাম স্টুডিয়েন’ বা ‘ইসলামিক স্টাডিজ’ প্রকাশ করে অটোমান সা¤্রাজ্যে সাড়া জাগিয়ে তোলেন। পরবর্তীকালে তারা ‘ইসলামী রাষ্ট্র’, ‘ইসলামী সাহিত্য’, ইসলামী জনগণ’ ইত্যাদি নামে সিরিজ গ্রন্থ প্রকাশ করতে থাকেন। জার্মানদের অনুসরণে ইংরেজ এবং ফরাসিরা ‘ইসলামিক’ শব্দটির প্রয়োগ উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিক থেকে শুরু করে বলে অনুমিত হয়। ইংল্যান্ডের একাডেমিক ফ্যাকাল্টিতে এই শব্দটির প্রথম প্রয়োগ হয় ১৯৩৮ সালে লন্ডন বিশ^বিদ্যালয়ে ‘স্কুল অব ওরিয়েন্টাল এ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজে’ বার্ণাড লিউইস (LEWISE)-এর ‘এ্যাসিস্ট্যান্ট লেকচারার ইন ইসলামিক হিস্ট্রি’ হিসেবে নিয়োগের মাধ্যমে। একে অনুসরণ করে ভারতীয় রাজনীতির প্রেক্ষাপটে চল্লিশের দশকে কলকাতা বিশ^বিদ্যালয়ে স্থাপিত হয় ‘ডিপার্টমেন্ট অব ইসলামিক হিস্ট্রি এ্যান্ড কালচার’। পরবর্তীতে বগুড়া আজিজুল কলেজে ১৯৩৯ সালে, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে ১৯৫০ সালে এবং রাজশাহী কলেজে ১৯৫৫ সালে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয়। রাজশাহী কলেজে ১৮টি বিষয়ে অনার্স কোর্স চালুর সময়ে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে অনার্স কোর্স চালু হয়নি। সুদীর্ঘ পথ-পরিক্রমা শেষে ১৯৫৫ সালে রাজশাহী কলেজের প্রথিতযশা অধ্যক্ষ প্রফেসর শামস-উল-হকের মহতি উদ্যোগে ১৯৫৫-৫৬ শিক্ষাবর্ষে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে প্রথম অনার্স কোর্স চালু হয়। মাত্র চারজন শিক্ষার্থী নিয়ে এ বিভাগের যাত্রা শুরু। শিক্ষার্থীরা হলেন- কামরুন রহমান, শিরিন আকতার, এনায়েতুর রহিম ও দবিরুজ্জামান মিঞা। এ চারজনের মধ্যে প্রফেসর কামরুন রহমান রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে, প্রফেসর শিরিন আকতার, জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে এবং প্রফেসর ড. এনায়েতুর রহিম প্রথমে রাজশাহী কলেজে, তারপর রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ে এবং ১৯৬৭ সালে আমেরিকার স্টেট বিশ^বিদ্যালয়, জর্জটাউন বিশ^বিদ্যালয় ও পেনসিলভানিয়া বিশ^বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। দবিরুজ্জামান মিঞা অনার্স গ্রেড পাননি, তিনি ডিগ্রি পাশ সনদ পান। এ বিভাগের কৃতি শিক্ষার্থীদের মধ্যে আরো ছিলেন তৃতীয় ব্যাচের মিসেস শামসুন্নাহার মোল্লা (অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়), ড. কছিম উদ্দিন মোল্লা (অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়), ড. মুখলেছুর রহমান (অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়), ড. এ কে এম ইয়াকুব আলী (প্রফেসর ইমেরিটাস, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়), আমিরুল হক (ব্যারিস্টার, সাবেক মন্ত্রী ও রাজনীতিবিদ)। বিভাগ প্রতিষ্ঠালগ্নে শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন দু’জন। যথা- অধ্যাপক সাইয়েদ আজিজুর রহমান হাশেমী ও অধ্যাপক মুখলেছুর রহমান (পরে অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয় ও কিউরেটর, বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর)। ১৯৫৬ সালে ড. শামসুদ্দিন মিয়া (পিএইচ. ডি, ক্যামব্রিজ বিশ^বিদ্যালয়, ল-ন, ১৯৬৪, পার্টটাইম শিক্ষক, রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়, অধ্যক্ষ, রাজশাহী কলেজ, চেয়ারম্যান, রাজশাহী ও ঢাকা শিক্ষাবোর্ড) ও ১৯৬০ সালে মো. আব্দুর রাজ্জাক শিক্ষক হিসেবে রাজশাহী কলেজে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে যোগ দেন। পরবর্তীতে তিনি রাজশাহী কলেজে উপাধ্যক্ষ পদে দায়িত্ব পালন করেন। এ বিভাগের আরও যাঁরা প্রথিতযশা শিক্ষক ছিলেন তাঁরা হলেন- প্রফেসর সফিউদ্দিন জোয়ারদার (১৯৬১ সালে রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন) এবং ১৯৫৯ সালে ড. এনায়েতুর রহিম রাজশাহী কলেজে এ বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন (১৯৬৪ সালে রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে যোগ দেন এবং কিছুদিনের মধ্যেই উচ্চশিক্ষার জন্য আমেরিকার পেনসিলভানিয়া বিশ^বিদ্যালয়ে যান এবং এম এ ডিগ্রি লাভ করেন। আমেরিকার জর্জটাউন বিশ^বিদ্যালয় থেকে পিএইচ. ডি, ১৯৭৩ এবং পরে স্টেট বিশ^বিদ্যালয় ও জর্জটাউন বিশ^বিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন।) এছাড়াও অনেক প্রাজ্ঞ ও অভিজ্ঞ শিক্ষকমন্ডলী ও বিভাগীয় প্রধানগণ অত্র বিভাগে নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৬০ সালে রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ে অনার্স খোলার অজুহাতে রাজশাহী কলেজে অনার্স কোর্স বন্ধ করার অপচেষ্টা গভর্ণর আযম খানের হস্তক্ষেপে ব্যর্থ হয়। ১৯০৫ সালে বিভক্ত বঙ্গের পূর্ব বাংলা ও আসাম প্রদেশের প্রথম গভর্ণর ব্যামফিন্ড ফুলার কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ফুলার ভবনের উত্তরাংশে এই বিভাগ চালু হয়, যা ২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ঐতিহ্যের সাথে একাডেমিক কর্মকা- অব্যাহত রাখে। যুগের প্রয়োজনে বিভাগের ব্যাপ্তি ও পরিধি বিস্তৃতির কারণে ২০১৭ সালের ১ জানুয়ারি শহীদ এ এইচ এম কামারুজ্জামান ভবনের নীচতলায় পশ্চিম দিকে বিভাগটি স্থানান্তরিত হয়ে আসে। এখানে পূর্বদিক থেকে ক্রমান্বয়ে অফিস, বিভাগীয় সেমিনার লাইব্রেরী, বিভাগীয় প্রধানের চেম্বার এবং সর্বপশ্চিমে বিভাগের শিক্ষকগণের রুম বিন্যাসিত হয়েছে। সুপরিসর ও সুন্দরভাবে সাজানো গোছানো বিভাগটি বর্তমানে একটি আদর্শ নান্দনিক বিভাগীয় কার্যালয়ের রূপ পরিগ্রহ করেছে। দেশের সরকারি কলেজগুলোর র্যাঙ্কিং-এ পরপর চারবার প্রথম হওয়া রাজশাহী কলেজে শ্রেণিতে পাঠদানসহ বিভিন্নমূখি শিক্ষার উন্নয়ন কর্মকা-ে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ ধারাবাহিক চর্চা ও পরিচর্যায় যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখে চলেছে। বিভাগের তিনটি শ্রেণিকক্ষে মাল্টিমিডিয়া ও প্রজেক্টরের মাধ্যমে সকল ক্লাস, বিভাগের ‘লাইট হাউস’ নামে একটি সংগঠনের নেতৃত্বে কো-কারিকুলাম এক্টিভিটিজ পরিচালিত হওয়া, বিভাগের ‘আবৃতি সংগঠন’, ‘সুঅভ্যাসের মাধ্যমে কর্মসংস্থান’ ইত্যাদি সংগঠন ছাড়াও ক্রীড়া ও সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রেও বিভাগটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। এই বিভাগ থেকে প্রতি বছরই ছাত্রছাত্রীরা দেয়ালিকা প্রকাশ করে আসছে। তবে আশার কথা, অধ্যক্ষ প্রফেসর মহা. হবিবুর রহমান এর নির্দেশনায় এবং সাবেক বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর নারগিস জাহানের অভিভাবকত্বে ‘ঝরোকা’ নামে একটি নিয়মিত ম্যাগাজিন সূচনা সংখ্যা, মার্চ ২০২০ সালে মুজিব বর্ষ উপলক্ষে প্রকাশিত হয়েছে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ১৯৬২-৬৩ শিক্ষাবর্ষ থেকে রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের অধীনে তিন বছর মেয়াদি ১৩০০ নম্বরের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় এবং ২০০০-২০০১ শিক্ষাবর্ষ থেকে জাতীয় বিশ^বিদ্যায়ের অধীনে চার বছর মেয়াদি সমন্বিত অনার্স কোর্স চালু রয়েছে। ১৯৯৩-৯৪ শিক্ষাবর্ষ থেকে বিভাগটিতে মাস্টার্স কোর্স চালু করা হয়। বিভাগটিতে একজন অধ্যাপক, তিনজন সহযোগী অধ্যাপক, চারজন সহকারী অধ্যাপক এবং চারজন প্রভাষকের পদসহ মোট বারোটি শিক্ষকের পদ রয়েছে। বর্তমানে ১০জন শিক্ষক ও তিনজন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারি কর্মরত রয়েছেন।