Bangla Sahittiki

বর্ষ : ০৭, সংখ্যা : ০১

আষাঢ়: ১৪৩১, জুলাই : ২০২৪

বাঙলা সাহিত্যিকী, ৫ম সংখ্য, শ্রাবণ ১৪২৫
ISSN 2227-1635

প্রাক-ঔপনিবেশিক আমলে বাংলার শিক্ষাব্যবস্থা: একটি পর্যালোচনা

ড. মো: মনজুর কাদির

সহযোগী অধ্যাপক (অব:)
ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ
রাজশাহী কলেজ, রাজশাহী, বাংলাদেশ

সারসংক্ষেপ: উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসন শুরু হওয়ার পূর্বে বাংলা তথা ভারতবর্ষে অতি প্রাচীন একটি নিজস্ব শিক্ষাধারা প্রচলিত ছিল। ভারতে প্রাচীন ও মধ্যযুগে যে ব্যাপকভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু ছিল তা হিন্দু, মুসলিম ও বৌদ্ধ ধর্মের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল। শিক্ষা ছিল গুরুগৃহ, টোল, চতুষ্পাঠী, মক্তব, ইমামবাড়া ও মাদ্রাসাকেন্দ্রিক। এ শিক্ষা দেশের মানুষের ধর্ম, রীতিনীতি, কৃষ্টি-সংস্কৃতি, ভাষা, সমাজ ব্যবস্থা, আবহাওয়া ও মানুষের চাহিদা অনুযায়ী গড়ে উঠেছিল। আধুনিক শিক্ষা প্রবর্তনের পূর্বে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এ দেশের মাটিতে দেশীয় লোক দ্বারা এ শিক্ষা পরিচালিত ও লালিত হতো। মোঘল শাসনের অবসানের পর এমন কি ব্রিটিশ শাসন প্রবর্তিত হওয়ার পরও দীর্ঘদিন ধরে এ শিক্ষাব্যবস্থা এদেশে চালু ছিল। এ শিক্ষা দেশীয় শিক্ষা নামে অভিহিত হতো। দেশীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো এ দেশের রাজা-বাদশাহ, ধনী ব্যক্তি, সমাজসেবী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের অর্থানুকূল্যে ও তত্ত¡াবধানে পরিচালিত হতো।১ এই প্রবন্ধে দেশীয় শিক্ষা ব্যবস্থাকে প্রাচীন যুগের শিক্ষা ব্যবস্থা এবং মধ্য যুগের শিক্ষা ব্যবস্থা নামে দুটি কালপর্বে ভাগ করে তৎকালীন শিক্ষা-ব্যবস্থার স্বরূপ সন্ধানের চেষ্টা করা হয়েছে।

প্রাচীন যুগের শিক্ষা ব্যবস্থা
প্রাচীন যুগে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে ইতিহাসকে ধরে রাখার পদ্ধতি প্রচলিত ছিল না। ফলে এ যুগে প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার সঠিক তথ্য আহরণ সম্ভব হয়নি। তবে যতটুকু জানা যায়, তার ওপর ভিত্তি করে রচিত ইতিহাস আমাদের কাছে যে তথ্য উপস্থাপন করে তা থেকে প্রাচীন যুগের শিক্ষাচিত্রের একটা রূপ উপস্থাপন করা যায়।
আর্য যুগের প্রথম দিকে ভারত উপমহাদেশে যে শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল তা ব্রাহ্মণ্য শিক্ষা নামে অভিহিত হতো। এ ব্যবস্থায় হিন্দু সমাজে শুধু ব্রাহ্মণদের মধ্যে শিক্ষাকার্য সীমাবদ্ধ ছিল। ধীরে ধীরে আর্য সমাজ নানারূপ বৃত্তিমূলক কাজে বিভক্ত হয়ে যায় এবং কালক্রমে গোঁড়া ধর্মীয় শ্রেণিতে রূপান্তরিত হয়। যথা- ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্র। শূদ্র শ্রেণিতে দেশের অনার্য আদি অধিবাসীরাও অন্তর্ভুক্ত ছিল বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়।
আর্য যুগে শিক্ষার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ব্রাহ্মণ শিশুদের পুরোহিত করে গড়ে তোলা। খ্রিঃপূঃ ৫০০ অব্দের কাছাকাছি ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য শিশুরা ব্রাহ্মণ শিক্ষকদের কাছে তাদের নিজ নিজ পেশার উপযোগী শিক্ষালাভ করতে শুরু করে। শিক্ষাক্ষেত্রে এই রূপান্তরের ফলস্বরূপ পরিষদ, টোল, পাঠশালা নামে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। পাঠশালা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কাজ করত এবং দেশের আদিম অধিবাসী ও শূদ্র সম্প্রদায় ছাড়া পাঠশালার দ্বার সকলের জন্য উন্মুক্ত ছিল।
সে-যুগে বাংলাদেশের প্রতিটি বড় বড় গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয় চালু ছিল। তবে এখনকার মত দালান-কোঠা বা টিনের চালাঘর তৈরি করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কাজ চালানোর ব্যবস্থা চালু ছিল না। গাছতলায়, মন্দিরে, বাড়ির প্রাঙ্গণে অথবা অতিথিশালায় এসব স্কুল বসতো। খুব বেশি হলে প্রতিটি স্কুলে কুড়ি জন ছাত্র থাকত। স্কুল পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে একজন শিক্ষক একটি স্কুলে শিক্ষকতায় নিয়োজিত থাকতেন। তিনি ছেলেমেয়েরদকে লেখাপড়া ও পৌরাণিক ইতিবৃত্ত শিক্ষাদান করতেন। এছাড়া গ্রামে দেব-দেবীর পূজা-অর্চনায় প্রধান ভূমিকা পালন করা শিক্ষকের অন্যতম কাজ ছিল। শিক্ষকের নির্দিষ্ট কোন বেতন ছিল না। তাকে তার কাজের পারিশ্রমিক হিসেবে নিষ্কর জমি অথবা ফসলের কিছু অংশ দেয়া হতো।
আর্য যুগে শিক্ষার উদ্দেশ্য অত্যন্ত সংকীর্ণ হওয়া সত্তে¡ও প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় কিছু সংখ্যক বিশিষ্ট পÐিত বিশেষত জ্যোতির্বিদ ও গণিতশাস্ত্রবিদের উদ্ভব হয়েছিল। শূন্যের ধারণা এ যুগের পÐিতদের কৃতিত্বের সাক্ষ্য বহন করে। এ যুগের পÐিতদের শূন্যের ধারণার ওপর ভিত্তি করে পরবর্তী সময়ে আরবীয় ও ইউরোপীয় পÐিতগণ গণিতশাস্ত্রকে দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করেন।২
পরবর্তীকালে বৌদ্ধ ধর্মের আবির্ভাব শিক্ষাক্ষেত্রে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। বৌদ্ধ মতবাদের ওপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছিল বৌদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থা। বৌদ্ধ শিক্ষার কেন্দ্র ছিল সঙ্ঘারাম। সঙ্ঘারামগুলো বৌদ্ধবিহার হিসেবেও খ্যাত ছিল। এ প্রতিষ্ঠানগুলোতে ধনী-নির্ধন নির্বিশেষে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় বৈশ্য, শূদ্র সকলের জন্য শিক্ষার দ্বার উন্মুক্ত ছিল। এর ফলে সঙ্ঘারামগুলোতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা দ্রæতগতিতে বৃদ্ধি পায় এবং এগুলো বৃহৎ আকারের শিক্ষায়তনে পরিণত হয়।
ভারতীয় উপমহাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সূচনা উল্লিখিত সঙ্ঘারামজাতীয় বৃহদাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল। এ দেশে জনশিক্ষা বিস্তারে বৌদ্ধরাই প্রথম উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। স¤্রাট অশোক প্রজাসাধারণের কল্যাণে আনুষ্ঠানিক পদ্ধতিতে জনশিক্ষা বিস্তারের জন্য অভিনব পদ্ধতি প্রবর্তন করেছিলেন। তিনি ধর্মাচারণ ও মানবীয় কল্যাণমূলক উপদেশমালা পর্বতগাত্রে উৎকীর্ণ করেছিলেন। এছাড়া শিক্ষাবিষয়ক স্তম্ভলিপিতেও তিনি নানা অনুশাসন খোদিত করে রাখার ব্যবস্থা করেছিলেন। এভাবে তাঁর শাসনামলে তাঁরই প্রতিষ্ঠিত অসংখ্য বৌদ্ধমঠ প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তারে কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করেছিলো।
বৌদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থার প্রথম পর্যায়ে প্রাকৃত ছিল জনশিক্ষার মাধ্যম। তবে সংস্কৃত, পালি, আঞ্চলিক ভাষা ও ধর্ম শিক্ষাও শিক্ষার্থীদের শেখানো হত। বৌদ্ধ ধর্মের প্রসারের সাথে সাথে শিক্ষাসূচিতে পরিবর্তন সূচিত হতে থাকে। বৈদিক শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত কিছু কিছু বিষয়ও বৌদ্ধবিহারে পঠন-পাঠনের ব্যবস্থা গৃহীত হয়।
উচ্চ শিক্ষার প্রসারে বৌদ্ধরাই প্রথম এ উপমহাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। বৌদ্ধ শাসনামলে প্রতিষ্ঠিত উচ্চশিক্ষার পাদপীঠ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আজও আমাদের শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের সমৃদ্ধ উৎস হিসেবে পরিচিত।৩