রাজশাহী জেলার পরিচিতি: ভূখণ্ড ও জনগোষ্ঠী
(প্রাচীনকাল থেকে ঊনিশ শতক পর্যন্ত)
ড. মোসা. ইয়াসমীন আকতার সারমিন
সহযোগী অধ্যাপক
ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ
রাজশাহী কলেজ, রাজশাহী, বাংলাদেশ
সারসংক্ষেপ: বাংলাদেশের চৌষট্টি জেলার অন্যতম একটি জেলা রাজশাহী। দেশের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত এ জেলার পাশ দিয়ে নামকরা পদ্মা নদী প্রবাহিত। দক্ষিণে ভারতের মুর্শিদাবাদ, পশ্চিমে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, পূর্বে নাটোর ও উত্তরে নওগাঁ জেলা নিয়ে পরিবেষ্টিত এ জেলার জন্ম ঔপনিবেশিক শাসনামলে হলেও প্রাচীনকাল থেকেই এর অবস্থান লক্ষ্য করা যায়। বিভিন্ন ধরনের প্রতœতাত্তি¡ক নিদর্শন, প্রাসঙ্গিক ঐতিহাসিক সূত্র, সরকারি নথিপত্র, সমকালীন ইতিহাস গ্রন্থ, পত্র-পত্রিকা এবং পর্যটকদের বিবরণী প্রভৃতির মাধ্যমে এর পরিচিতি ও অবস্থান সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করা যেতে পারে।
প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলার বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে ঐতিহাসিকগণ এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, ‘বর্তমান বাংলার উত্তর অংশই অর্থাৎ রাজশাহী, দিনাজপুর, রংপুর ও বগুড়া জেলা পুÐ্র জনপদ ভুক্ত ছিল। ধারণা করা যায় যে, সে সময়ের এই জনপদটি একটি বিস্তীর্ণ ভূভাগ জুড়েই ছিল। এই বিশাল ভূখÐটি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বংশীয় শাসক শ্রেণির দ্বারা শাসিত হত। যে অঞ্চলটি ‘সেন রাজাদের সময় বরেন্দ্রভূমি নামে পরিচিতি লাভ করে সেই অঞ্চলটিকেই বর্তমান রাজশাহী জেলা বলে ধারণা করা হয়। সেন বংশের অবসান এবং ত্রয়োদশ শতকের শুরুতে বাংলার উত্তরদিকে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হলে এ অঞ্চলে মুসলিম শাসন ও ইসলাম ধর্ম প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে ‘শাসন ক্ষমতা পরিবর্তনের সাথে সাথে এর সীমানাও পরিবর্তিত হয়েছে।’ ইতিহাসের কালপঞ্জি অনুসারে ষষ্ঠদশ শতকের তৃতীয় দশকে ভারতে মোঘল বংশীয় শাসনের সূত্রপাত হয়। এরপর এ অঞ্চল ইংরেজ তথা ঊপনিবেশিক শাসনের অন্তর্ভুক্ত হয়। এ দুই শাসনামলে ‘পদ্মা নদীর দক্ষিণে নিজ চাকলা রাজশাহী নামে একটি ভূভাগ ছিল এবং ইংরেজ আমলে ঐ চাকলা রাজশাহী নামে উৎপত্তি হয়।’ ‘রাজশাহী’ শব্দটি সংস্কৃত ও ফার্সি শব্দের মিলিত রূপ। মুসলমান সুলতান ‘শাহ’ এবং হিন্দু শাসক ‘রাজা’ হিসেবে পরিচিত। তাই হিন্দু রাজার মুসলমান অঞ্চলে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে একে ‘রাজশাহী’ নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
প্রাচীনকাল থেকেই এ ভূখÐটিতে যে জনবসতি গড়ে উঠেছিল তা ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত। এ কথা সত্য যে, সেই সময়ের জনপদগুলো মূলত সেখানে বসবাসকারী জন গোষ্ঠীর নামানুসারে পরিচিত হত, তদনুযায়ী পুÐ্র বা পুÐ্রবর্ধনভুক্তি জনপদে ‘পৌÐক’ নামক জনগোষ্ঠী বসবাস করতো। পরবর্তীতে এ অঞ্চলে বহিরাগতদের সংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পায়। বিশেষ করে বিভিন্ন বংশীয় শাসকদের শাসনামলে এই জনপদের ভৌগোলিক সীমানার যেমন পরিবর্তন ঘটেছে তেমনি জনগণের জীবন ধারাতেও পরিবর্তন এসেছে। আলোচ্য প্রবন্ধে ঐতিহাসিক তথ্য ও উপাত্তের ভিত্তিতে প্রাচীন কাল থেকে উনিশশতক পর্যন্ত এ জেলার ভূখÐ ও জনগোষ্ঠীর ক্রমবিকাশ আলোচনা করা হল।
ভূখÐ
বর্তমানের রাজশাহী, যা পূর্বে পুÐ্র জনপদ নামে পরিচিত, তা ছিল কোমভিত্তিক জনপদ। ‘পুÐ্র’ জনপদও ছিল কোমভিত্তিক জনপদ। বাংলায় প্রাপ্ত বিভিন্ন শিলালিপি এবং সংস্কৃত গ্রন্থগুলোতে ভিল্ল, মেদ, আভীর, কোল, পৌন্দ্রক (পোদ), পুলিন্দ, ওড্র, দ্রাবিড় প্রভৃতি পার্বত্য ও ভিন্ন দেশী কোম বা গোষ্ঠীর নাম পাওয়া যায়। এর মধ্যে পুÐ্রকেরা বা পুÐ্ররা সমগ্র উত্তরবঙ্গ জয় করে নেয়। সম্ভবত এ কারণে ঐতিহাসিকগণ অনুমান করেন এ পুÐ্র কোমের নামের সঙ্গে প্রাচীন বাংলার পুÐ্র বা পুÐ্রবর্ধন জনপদের নামকরণের সম্পর্ক রয়েছে।
সুপ্রাচীনকাল থেকেই পুÐ্র জনপদটি অত্যন্ত শক্তিশালী ও প্রসিদ্ধ জনপদ ছিল বলে জানা যায়। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে উত্তর ভারতে মৌর্য সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। পুÐ্র রাজ্য তখন মৌর্য্য সাম্রাজ্যভুক্ত হয় এবং রাজধানীর নাম হয় পুÐ্রবর্ধন । ‘মহাস্থান গড়ে’ প্রাপ্ত লিপি থেকে জানা যায় সমগ্র উত্তর বাংলা অর্থাৎ পুÐ্রবর্ধন মৌর্য সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এ অঞ্চলের শাসন কেন্দ্র ছিল পুÐ্রবর্ধন বা পুÐ্রনগর যা বর্তমানে বগুড়া জেলার মহাস্থানগড়ে অবস্থিত।
খ্রিস্টীয় চতুর্থ ও পঞ্চম শতকে গুপ্ত বংশীয় রাজাগণ ভারতে বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। গুপ্ত আমলে বাংলার অধিকাংশ এলাকাই গুপ্ত সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। এ সময় কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থা ভুক্তি(প্রদেশ), বিষয়(জেলা), মÐল, বিথি(গ্রাম) ইত্যাদি ভাগে বিভক্ত ছিল । গুপ্ত রাজত্বকালের ভ‚মিদান বিষয়ক ছয়খানি তাম্রশাসন আবিষ্কৃত হয়েছে। এসকল তাম্রশাসন বিশ্লেষণের ভিত্তিতে অনুমান করা যায় যে, গুপ্ত আমলে পুÐ্রবর্ধন নামক ভুক্তিটি উত্তরাঞ্চলের বগুড়া, দিনাজপুর ও রাজশাহী জেলা জুড়ে বিস্তৃত ছিল । ‘গৌড় রাজমালা’ এবং ‘অশোকাবদান’ নামক দুটি গ্রন্থে পুÐ্রবর্ধন সম্রাট অশোক-এর সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল বলে জানা যায়।
গুপ্ত আমলে প্রসিদ্ধ চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং আনুমানিক ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় আসেন। তাঁর বর্ণনায় ‘পুন্ন-ফ-তন্ন’ নামক যে জনপদের চৈনিক নাম পাওয়া যায় তাই ‘পৌÐ্রবর্ধন’ বলে প্রমাণিত হয়েছে। তিনি এই দেশকে সমৃদ্ধশালী, জনবহুল এবং সুন্দর আবহাওয়া সম্পন্ন বলে বর্ণনা করেছেন।
শশাঙ্কের রাজত্বের প্রথম দিকে রাঢ়, পুÐ্র একত্রিত হয়ে ঐক্যবদ্ধ গৌড় রাজ্য গড়ে উঠে এবং পুÐ্রনগর রাজধানী পরিত্যক্ত হয়ে বর্তমান মুর্শিদাবাদের কর্ণসুবর্ণে রাজধানী স্থাপিত হয়। শশাঙ্কের মৃত্যুর পর প্রায় একশত বৎসর (৬৫০-৭৫০) ধরে বাংলায় মাৎস্যন্যায় অবস্থা বিরাজ করেছিল। শশাঙ্কের গড়া গৌড় রাজ্য থেকে পুÐ্র রাজ্য বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কারণ অষ্টম শতাব্দীর প্রারম্ভে শৈলবংশীয় একজন রাজা পুÐ্রদেশ জয় করে নেন।