বিপন্ন অতীতের মাঝে বর্তমানের বিশ্ববীক্ষণ অসংবৃত অন্ধকার
প্রফেসর ড. শিখা সরকার
বিভাগীয় প্রধান, বাংলা বিভাগ
রাজশাহী কলেজ, রাজশাহী, বাংলাদেশ
সারসংক্ষেপ: সৃষ্টির আদি থেকেই শুভ আর অশুভ শক্তির দ্ব›দ্ব। পৌরাণিক যুগে এই অশুভ শক্তি দানব বা রাক্ষস নামে পরিচিত। তারা দেবতাদের সাথে প্রতিনিয়ত দ্বদ্বে অবতীর্ণ হতো। স্বীয় স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য যারা মানব সভ্যতাকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়েছে ইতিহাসের সেই ঘৃণ্য কুচক্রীদের মাঝে কবি অনীক মাহমুদ পুরাণ খ্যাত দানব বা রাক্ষসদের অবলোকন করেছেন। পৌরাণিক দানব এবং ইতিহাসের নিষ্ঠুর অত্যাচারীদের সমকালের চেতনায় বিশ্লেষণ করেছেন সব্যসাচী কবি অনীক মাহমুদ তাঁর অসংবৃত অন্ধকার কাব্যগ্রন্থে। বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনায় সমৃদ্ধ কবির এই কাব্যগ্রন্থটিতে ইতিহাস এবং মিথের সাথে পরবর্তীকালের অশুভ চরিত্রগুলোর তূল্যস্বরূপ সন্ধান আলোচ্য প্রবন্ধের মূল লক্ষ্য।
পৌরাণিক যুগের অসুর দানবদের অশুভ শক্তি উন্মোচনের এক অনবদ্য কাব্যিক নিদর্শন কবি অনীক মাহমুদের অসংবৃত অন্ধকার। দেবতা অসুরের দ্ব›েদ্বর পটভ‚মিকায় তিনি নির্মাণ করেছেন ছত্রিশটি দানবচরিত্র। তারা প্রত্যেকে দেবতার সাথে যুদ্ধ করে ক্ষমতার দম্ভে বলীয়ান। গ্রন্থটি দুটি পর্বে বিভক্ত। একটি ‘অন্তঃপাতী কাÐ’ অন্যটি ‘আশ্রম কাÐ’। ‘আশ্রম কাÐ’ নাম উপদ্রæত তপোবন। ‘অন্তঃপাতী কাÐে’ পৌরাণিক অসুরদের সঙ্গে যোগ হয়েছে বৃন্দাসুর- যারা মানবরূপী শয়তান। মানুষের আসুরিক প্রবৃত্তি সুখ শান্তি সভ্যতা বিনষ্টকারীদের নিয়ে ‘বৃন্দাসুর’। অতীতকে বর্তমানের ¯্রােতে মিলিয়েছেন সমাজ সচেতন কবি অনীক মাহমুদ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর যুদ্ধ পীড়িত মানুষের জীবন গ্রাস করে নৈরাশ্য, হতাশা। মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের অশনী সংকেত সচেতন মানুষকে আলোড়িত করে তীব্রভাবে। জীবনের শেষপর্বে রবীন্দ্রনাথও লিখেছেন-
নাগিনীরা চারিদিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস
শান্তির ললিত বাণী শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস
বিদায় নেবার আগে তাই ডাক দিয়ে যাই,
দানবের সাথে যারা সংগ্রামের তরে প্রস্তুত হতেছে ঘরে ঘরে।
পরপর দুটি বিশ্বযুদ্ধ, সাতচল্লিশের দেশভাগ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধোত্তর সঙ্কট, রাজাকারদের নব উত্থান, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সাথে মানুষের বেশ পরিবর্তন, টুইন টাওয়ার ধ্বংসসহ সমকালের ঘটনাবলীÑ যেখানে মানবতা লাঞ্ছিত হয়েছে তাতে উদ্বিগ্ন কবি অনীক মাহমুদ। সমকালের ঘটনাবলীকে তিনি পুরাণ এবং ইতিহাসের আলোকে পুনর্মূল্যায়ন করেছেন। “এ পৃথিবী রাবণাক্ত গলদের ভারপট্টি থেকে মুক্তির নিশানা খোঁজে হার্দ্য কলাক্ষেত্র গরিমান চিরশ্রী টোপর” Ñ এই প্রত্যাশায় কবির অসংবৃত অন্ধকার।
ঋকবেদ এবং অথর্ববেদে বলা হয়েছে- যারা দেবতা বিরোধী, যাদের সুধা নেই, সমুদ্র মন্থনে উত্থিত অমৃত থেকে যারা বঞ্চিত তারাই অসুর। ঐতরেয় ব্রাহ্মণে আছে, প্রজাপতির নিঃশ্বাস একবার প্রবল বেগে বইছে। সেই নিঃশ্বাস হতে অসুরদের জন্ম হয়। এরা দেবপূজা ও যজ্ঞ ধ্বংস করতো। এরা রাত্রি ও অন্ধকারের প্রতীক। এজন্যই কবি অনীক মাহমুদ তাঁর কাব্যের নামকরণ করেছেন অসংবৃত অন্ধকার। অসুর চরিত্র উন্মোচনে এই কাব্যিক আয়োজন।
অসুরদের মত দানব এবং রাক্ষসরাও দেবতা বিরোধী। তবে এদের উৎপত্তি এক নয়। কশ্যপ এবং দনুর গর্ভজাত সন্তানরা দানব নামে খ্যাত। রাক্ষসদের উৎপত্তি সম্বন্ধে রামায়ণে আছে যে ব্রহ্মা জল সৃষ্টি করে তা রক্ষার আদেশ দিয়েছিলেন যাদের তারাই রাক্ষস। তবে ঐতিহাসিকদের মতে আর্যদের আগমনের পূর্বে যে জাতি এদেশে বসবাস করতো তাদের অনার্য রাক্ষস বলা হতো। দৈহিক গঠনে এরা আর্যদের মত সুশ্রী নয় বরং কদাকার। এই রাক্ষস বংশের সবচেয়ে প্রতাপশালী লঙ্কার রাজা রাবণ। অসংবৃত অন্ধকার গ্রন্থের প্রথম কবিতার নাম রাবণ। রামায়ণের রাবণ চরিত্র যেভাবে বর্ণিত হয়েছে কবি সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই রাবনকে নির্মাণ করেছেন। রাবণের দৈহিক গঠন রামায়ণ অনুযায়ী – “দশ মস্তক, বিশ বাহু, প্রদীপ্ত কেশী, ঘোরকৃষ্ণ, লোহিতওষ্ঠ, বীভৎস দর্শন।” বিশ্বশ্রবা মুনি এবং নিকষার জ্যেষ্ঠ পুত্র রাবণ। তপস্যায় সিদ্ধ হয়ে ব্রহ্মার বরে দেবতা, রক্ষ-যক্ষের অবধ্য। মানুষকে রাবণ তুচ্ছ জ্ঞান করতেন। প্রবল পরাক্রান্ত রাবণ বৈমাত্রেয় ভ্রাতা কুবেরের লঙ্কা অধিকার করে লঙ্কার রাজা হন। বেদবতী এবং রম্ভার সতীত্ব নাশ করায় নলকুবেরের অভিশাপ ছিলÑ যদি রাবণ বলপূর্বক কোন নারীর সম্ভ্রম হরণ করে তবে তৎক্ষণাৎ তার মৃত্যু হবে। এ কারণে সীতা হরণ করেও সীতার প্রতি কখনো বলপ্রয়োগ করেনি রাবণ।